কিন্তু অতি সম্প্রতি এই কমিশনের বেশ কিছু সুপারিশ নিয়ে বিসিএস শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের ভেতর আপত্তি দেখা যায়। এর মধ্যে যে সুপারিশটি বিসিএস স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ভেতর তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে সেটি হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডার বাতিলের সুপারিশ। কর্মকর্তাদের সংখ্যার দিক দিয়ে বিসিএস শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বড় ক্যাডার। কমিশনের পরিকল্পনা, পিএসসি থেকে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন যেমন আলাদা হয়েছে, একই রকমভাবে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্যাডারকে আলাদা করা। বিশেষায়িত হিসেবে এ দুটি বিভাগে প্রয়োজনে বেতন বাড়ানো হতে পারে বলেও মনে করে সংস্কার কমিশন।
সুপারিশটি গনমাধ্যমে প্রকাশিত হবার পর থেকেই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। ইতোমধ্যেই বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার এসোসিয়েশন এবং হেলথ ক্যাডার এসোসিয়েশন এ ব্যাপারে তাঁদের অফিসিয়াল বিবৃতিতে এমন যে কোন পরিকল্পনার ব্যাপারে উক্ত দুই ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নেতিবাচক মনোভাবের কথাটি ব্যক্ত করেছে। এছাড়াও, এ সুপারিশ জানাজানির পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র আপত্তি জানিয়ে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন বিসিএস শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের অনেক কর্মকর্তা।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারকে আলাদা করার পক্ষে কমিশনের যুক্তিঃ
মূলতঃ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারকে আলাদা করার পেছনে কমিশনের যেসব যুক্তি গণমাধ্যমে উঠে এসেছে তা হলো আলাদা জব নেচার, পদোন্নতি এবং বেতনের কাঠামো । এ প্রসঙ্গে ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪ দৈনিক প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে কমিশনের প্রধানের বরাত দিয়ে বলা হয় যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের পদোন্নতির কাঠামো থেকে শুরু করে কাজের ধরনের পার্থক্যের কারনে এই দুই বিভাগে কর্মরত কর্মকর্তাদের বেতন বাড়িয়ে জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের মত আলাদা কাঠামো করা যেতে পারে। জনপ্রশাসন সচিবও এসময় জুডিসিয়াল সার্ভিসের মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে আলাদা করার কথাই বলেন বলে একই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়!
সংশ্লিষ্ট ক্যাডার কর্মকর্তাদের বিরোধিতাঃ
ইতোমধ্যেই বিসিএস শিক্ষা ও বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের এসোসিয়েশনগুলোর পক্ষ হতে এমন সুপারিশের বিরোধিতা করা হয়েছে। বিসিএস হেলথ ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক মোহাম্মদ নেয়ামত হোসেন ও সদস্যসচিব উম্মে তানিয়া নাসরিন এক বিবৃতিতে এই সংস্কার প্রস্তাবকে ‘হঠকারী সুপারিশ’ উল্লেখ করে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
বিবৃতিতে তারা বলেছেন, স্বাস্থ্যের নীতিনির্ধারণী পর্যায়গুলোতে পুরোপুরি অনভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের পদায়ন করে মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্যকে বিজ্ঞানভিত্তিক ও যুগোপযোগী না করে বরং উল্টো পথে হেঁটে আমলাতান্ত্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনা কায়েম করেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল ও নীতিনির্ধারণী পদগুলোতে স্বাস্থ্য ক্যাডারের দক্ষ কর্মকর্তাদের পদায়ন করে বিজ্ঞানভিত্তিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব বলে জানান তারা।
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ তাজিব উদ্দিন এক বিবৃতিতে সংস্কার কমিশনের এই সুপারিশকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। একই সঙ্গে অবিলম্বে এই প্রচেষ্টা বন্ধ করার দাবিও জানিয়েছেন।
প্রতিবাদলিপিতে তারা বলেন, সংবাদমাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার ও বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারকে কাঠামোর বাইরে রাখার সুপারিশ করতে যাচ্ছে। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের ১৬ হাজার সদস্যের একক মুখপাত্র বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশন এই সুপারিশ সর্বোতভাবে প্রত্যাখ্যান করছে।
কেন এই সুপারিশ বাস্তবায়নযোগ্য নয়?
একটি সরকার চাইলে যে কোন কর্মবিভাগ পুনর্বিন্যাস করতে পারে –এই বাস্তবতা মাথায় রেখেই বলতে হচ্ছে যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডার বহির্ভূত করার সুপারিশ ২০২৪ এর বৈষম্যবিরোধী স্পিরিটের সাথে সাংঘর্ষিক। স্মরণযোগ্য যে পাকভারত উপমহাদেশে ক্যাডার সার্ভিস ধারনার প্রবর্তক হলো ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার । কিন্তু ব্রিটিশ আমলে একীভূত সিভিল সার্ভিস ছিলো না। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস নামে যেমন একসময় কলোনিয়াল এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস চালু ছিলো, তেমনি ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিস এবং ইন্ডিয়ান হেলথ সার্ভিসেরও অস্তিত্ব ছিলো। এই পর্যন্ত পড়ে যারা ধরে নিচ্ছেন যে তাহলে এর ধারাবাহিকতায় তো এই দুটো সার্ভিসকেও আলাদা করে ফেলা যায়, তাদের বলব একটু সবুর করুন, আরও কিছু কথা আছে যা এখানে বলা দরকার। প্রথমত, ইন্ডিয়ান এডুকেশন ও হেলথ সার্ভিস বর্তমান বাংলাদেশের এডুকেশন এবং হেলথ ক্যাডারের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষমতায়িত ছিলো। উদাহরনস্বরূপ বলা যায় যে ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিসের অনেক কর্মকর্তারাই বিভিন্ন ভারতীয় রাজ্যের শিক্ষা প্রশাসকের দায়িত্ব হতে শুরু করে ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরির প্রধান গ্রন্থাগারিকের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক স্যার সৈয়দ আহমদ খানের পৌত্র স্যার রস মাসুদ ছিলেন হায়দ্রাবাদের ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইন্সট্রাকশন, যা সচিব সমতুল্য পদ ছিলো। অন্যদিকে হাকিম মনজুর ছিলেন কাশ্মীরের শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টর। ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিসের প্রথম ভারতীয় কর্মকর্তা প্রফেসর হরিনাথ দে ছিলেন ইন্ডিয়ান পাবলিক লাইব্রেরির প্রথম ভারতীয় লাইব্রেরিয়ান। ইন্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিসের ইতিহাস তো আরও কৌতূহলউদ্দীপক। ব্রিটিশ আর্মির এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য এমনকি ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আগেই শুরু হয় ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিস। ম্যালেরিয়ার জীবানু আবিষ্কারকারী স্যার রোনাল্ড রসের মতো খ্যাতিমান চিকিৎসা বিজ্ঞানী কাজ করেছেন এই সার্ভিসে।
অর্থাৎ শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ক্যাডারের জন্মও কলোনিয়াল ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায়, যে ধারাবাহিকতায় এক সময় জন্ম নিয়েছিলো এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস। পরবর্তীতে ১৯৩০ সালের ভারত শাসন আইনে এই দুই বিভাগের দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের হাতে দেওয়া হলেও এমনকি পাকিস্তান আমলেও এই দুটো সার্ভিসের কর্মকর্তাদের কর্মপরিধি অনেক বেশি ছিলো। স্বাধীনতার পর ১৯৮০ সালে এদেশে প্রথম একীভুত সিভিল সার্ভিস গঠন করা হলে অন্যান্য প্রাদেশিক সার্ভিসের মতই এই দুটো সার্ভিসকে সিভিল সার্ভিসের আওতায় নেওয়া হয়। প্রশাসন ক্যাডারের কম্পোজিশন রুলস অনুযায়ীও কিন্তু একদিকে কেন্দ্রীয় সিএসপি ক্যাডার যেমন বিসিএস এডুকেশন ক্যাডারের অন্তর্ভুক্ত হন, তেমনি প্রাদেশিক ইস্ট পাকিস্তান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এবং এমনকি মিলিটারি ল্যান্ড সার্ভিসের কর্মকর্তারাও বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের অন্তর্ভুক্ত হন। তাই ঐতিহ্য আর কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসের কৌলিন্যের দোহাই দিয়ে কোন ক্যাডারকে আলাদা করার সুযোগ নেই। অধিকিন্তু বিভিন্ন সময়ে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারকে সহযোগিতা করাসহ বহু অভিযোগ আছে, সেগুলো তদন্তসাপেক্ষ এবং বর্তমান নিবন্ধের আলোচ্যসূচীর বাইরে বলে আমি এ ব্যাপারে কিছু বলব না। কিন্তু শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ক্যাডার এমনিতেই হাজারটা সমস্যায় নিমগ্ন। এই দুই ক্যাডারে কোন গ্রেড ১ পদ না থাকার কারনে নিজ নিজ ক্যাডারের সার্বিক ব্যবস্থাপনা এই দুই ক্যাডারের হাতে নেই। পদোন্নতি থেকে শুরু করে পদায়ন- সবকিছুর জন্য অন্য ক্যাডারের ওপর নির্ভর করতে হয়। জুডিসিয়াল সার্ভিসের সাথে এই দুই ক্যাডারের তুলনা চলে না কারন বিচার বিভাগ পৃথকীকরনের ব্যাপারে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে, এই দুই ক্যাডারকে আলাদা করার ব্যাপারে তেমন বাধ্যবাধকতা নেই। এছাড়া, গনমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে যে এই দুই ক্যাডারকে আলাদা সার্ভিস করে বেতনবৃদ্ধির প্রস্তাব করা হচ্ছে কিন্তু তাদেরকে ক্ষমতায়িত করার কোন প্রস্তাব আমরা দেখছি না। তাই এই দুই ক্যাডারের কর্মকর্তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারন আছে। গত ১৫ বছরে এই দুই ক্যাডারের কর্মপরিধি যথেষ্ট খর্ব হয়েছে। বিগত সরকারের আমলে ১৯৮০ সালের ক্যাডার কম্পোজিশন রুলসের ব্যতয় ঘটিয়ে এই দুই ক্যাডারের কর্মক্ষেত্রও সংকোচিত হয়েছে। ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাফল্যের পরপরই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা আন্তঃক্যাডার বৈষম্যনিরসনের আন্দোলন শুরু করেন। তাই, বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে এই দুটো ক্যাডারকে আলাদা সার্ভিস না করে বরং তাদের ক্যাডারের শিডিউলভুক্ত পদ্গুলো সংরক্ষন এবং তাদেরকে আরও ক্ষমতায়িত করলেই ২৪র বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ‘স্পিরিট’ রক্ষা পাবে।
আদনান হোসেন, সহকারী অধ্যাপক(ইংরেজি), ঢাকা কলেজ, বিসিএস সাধারন শিক্ষা
( এটি লেখকের একান্ত নিজস্ব মতামত, এর দায়ভার লেখকের নিজের )