‘কাগজের আইন করে প্রাকৃতিক মাছকে ‘রুখে’ দেয়া যায়নি
২৮ ডিসেম্বর, ঢাকা: সাকার মাছ নিধন নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা নেই মৎস অধিদপ্তরের। এমনটি জানালেন, অভ্যন্তরীণ মৎস বিভাগের পরিচালক মোঃ জিয়া হায়দার চৌধুরী । এই পরিচালক গণযোগকে বলেন, ‘সাকার মাছের ক্ষতিকর দিকেটি জানার জন্য ও এবিষয়ে সুনির্দিষ্ট গবেষণার জন্য, আমরা প্রাথমকিভাবে একটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট অনুষদের সাথে অনানুষ্ঠানিকভাবে কথা বলেছি। তবে এটি কোন সরকারি পদক্ষেপ নয়।’ সাকার মাছ নিয়ে নিধনে এখনো তারা কোন আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ নেন নি। তবে এই কর্মকর্তা বলেন, তাদের কিছু করার ইচ্ছা আছে।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মাসে সাকার মাছ নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, কেউ সাকার মাছ আমদানি, প্রজনন, চাষ, পরিবহন, বিক্রি, গ্রহণ বা প্রদান, বাজারজাতকরণ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও মালিক হতে পারবেন না।
তবে কাগজের আইন করে প্রাকৃতিক মাছকে ‘রুখে’ দেয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে জানা যায়,
স্থানীয় জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের কারণ হতে পারে এই সাকার মাছ। এটি এমন এক প্রজাতির মাছ, যা বিশ্বব্যাপী জলাভূমির বাস্তুতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠেছে। মূলত আমাজন অববাহিকা থেকে মাছটি সারা বিশ্বের বিভিন্ন জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এটি স্থানীয় প্রজাতি বিনাশ করছে এবং সূক্ষ্মভাবে পরিবেশগত ভারসাম্যকে ব্যাহত করছে। সাকার মাছ হলো একটি সর্বভূক ধরনের শিকারি মাছ। এর খাদ্যতালিকায় রয়েছে ছোট মাছ, ক্রাস্টেসিয়ান, ছোট ছোট উভচর প্রাণী ও তার লার্ভা। এছাড়াও এটি অন্যান্য জলজ প্রাণীও খেয়ে থাকে। ফলে স্থানীয় জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিছু এলাকায় সাকার ফিশ দেশীয় প্রজাতির অনেক মাছকে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন,
স্থানীয় প্রজাতির ওপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব রাখা ছাড়াও সাকার মাছের উপস্থিতি সমগ্র খাদ্য জাল এবং পরিবেশগত প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে। এর সুদূরপ্রসারী পরিণতি হতে পারে পানির গুণমান থেকে পুষ্টির চক্র পর্যন্ত সবকিছুকে বিনষ্ট করা। শিকার ছাড়াও সাকার ফিশ বাসা বাঁধার জায়গা এবং প্রজনন স্থানের জন্য স্থানীয় প্রজাতির মাছের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। তাদের আক্রমণাত্মক আচরণ স্থানীয় প্রজাতির বিলুপ্তির প্রক্রিয়া আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
বাংলাদেশে এর বিস্তারের শেকড়ঃ
খোঁজ নিয়ে জানা যায়,
দেশে অ্যাকুয়ারিয়াম ব্যবসা এবং বাসাবাড়িতে জলজ প্রাণী পালনের মাধ্যমে সাকার মাছের আবির্ভাব ঘটেছে । মাছটির বিশেষ বর্ণ এবং প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকার মতো বৈশিষ্ট্যগুলো মানুষকে আকৃষ্ট করে এবং তা পালনে আগ্রহী করে তোলে। কিন্তু অ্যাকুরিয়ামের অন্য মাছের ক্ষতি বা লালনপালনে অসুবিধা হলে মানুষ তা ড্রেনে বা ছোট জলাশয়ে ছেড়ে দেয়। পরবর্তী সময়ে সাকার মাছ ভেসে যায় মুক্ত জলাশয়ে।
সাকার মাছ দ্রুত প্রজনন ঘটিয়ে বংশবিস্তার করে ফেলেছে। ফলে এদের নির্মূল প্রচেষ্টা চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাড়িয়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান, সাকার মাছ নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করায় মানুষ মাছটি আমদানি, অ্যাকুয়ারিয়ামে পালন বা বিক্রি কিংবা প্রজনন কিছুই করতে পারছে না। তবে এ আইনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিলে দেশীয় প্রজাতির মাছ সংরক্ষণে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে বিষয়টি নিয়ে তেমন কোন গতি নেই। নিধন না করতে পারলে আইন তৈরি করা ই যথেষ্ট নয়। তিনি বলেন, মাছটি নিধনে সরকারের সক্রিয় উদ্যোগ ও সমন্বিত পদক্ষেপ, এই আক্রমণাত্মক প্রজাতির মাছের বিস্তার রোধ করতে এবং দুর্বল বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করতে সহায়ক হতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাকার মাছ যেখানেই রাখা হোক না কেন, তা জলাভূমির জীববৈচিত্র্যের জন্য একটি বড় হুমকি। এর আক্রমণাত্মক আচরণ, দ্রুত প্রজনন এবং প্রতিযোগিতামূলক বৈশিষ্ট্য এটিকে একটি ক্ষতিকর মাছে পরিণত করেছে। বিশ্বব্যাপী জলজ বাস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য সাকার মাছের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা অপরিহার্য।
বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীতে আহরোণযোগ্য মাছের পরিমান একেবারে হ্রাস পেয়েছে এই সাকার মাছের বিস্তারে কারনে। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, প্রতিদিন সকাল দুপুর কিংবা রাতে জেলেদের জালে কয়েকটন সাকার মাছ ধরা পড়ছে। নদী তীরের পানির কাছকাছি গেলে এর উন্মুক্ত বিচরন চোখে পড়ার মত।
তুরাগ তীরের জেলে হোসেন আল ী বলেন, এই সাকার মাছের কারনে আমাদের ভাগ্য-বিপর্যয় ঘটছে। অথচ সরকার কোন পদক্ষেপই নিচ্ছেনা।
বুড়িগঙ্গা নদীর আরো ক’জন জেলে তাদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেন।
তারা এই প্রতিবেদককে জানান, সাকার মাছের কারনে দু’জন মানুষ মিলে ৭-৮ ঘন্টা নদীতে থেকে ২ কেজি খাওয়ার মাছও ধরতে পারেন না। বিষয়টি নিয়ে সরকারের পদক্ষেপের আশা করছেন তারা।