নাজনীন নাহার তন্বী: প্রকৃতিতে শীতের আগমনের সাথে সাথে রুক্ষতা বাড়ে ত্বকে। আর এই রুক্ষতা থেকে মুক্তি লাভে অপরিহার্য সঙ্গী হয়ে উঠে নানা প্রসাধন সামগ্রী।
আলো ঝলমলে বিপনি-বিতান থেকে শুরু করে ছোট বড় সকল দোকান গুলোতে ছড়িয়ে রয়েছে নানারকম প্রসাধন সামগ্রী। দেশী বিদেশী বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এসকল প্রসাধন সামগ্রী আসল নকল ভেদাভেদ করতে ক্রেতাদের প্রায়শই হিমসিম খেতে হচ্ছে। এর ফলে পণ্যের গুনগত মান নিয়ে তাদের মধ্যে প্রতিনিয়ত সংশয় তৈরি হচ্ছে । সেই সাথে বাড়ছে ক্যান্সারের মত দূরারোগ্য রোগের ঝুঁকি।
বাজারে ত্বকের যত্নে ব্যবহৃত পণ্যের চাহিদা কে পুঁজি করে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী নকল পণ্যকে আসল পণ্যের মোড়কের আদলে বিক্রি করছে। ফলে অহরহ প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা। একই সাথে তারা নানা ধরনের ত্বকের জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছেন। বিশেষ করে নারী ক্রেতাদের বেলায় বিষয়টি অধিকতর সংবেনশীলতা তৈরি করছে।
বর্তমান সময়ে দাড়িয়ে ত্বকের যত্নে প্রসাধনী ক্রয়ের ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করছে অনেক তরুণী। একাধিকবার পন্য ক্রয় করে গুনগত মানের দিকে থেকে তারা প্রতারিত হয়েছেন বলেও এই প্রতিবেদক কে জানিয়েছেন।
এবিষয়ে জানতে চাইলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পড়ুয়া আসমা নামের একজন তরুনী গণযোগকে জানান, পণ্যের গুনগত মান নিয়ে দ্বিধাহীন থাকতে অত্যন্ত নামীদামি সুপারশপ থেকে নিয়মিত পণ্য ক্রয় করে থাকেন। তারপরেও তিনি বিদেশি মোড়কে, দেশে তৈরি নকল পণ্য পেয়ে প্রতারিত হয়েছেন।
এছাড়াও বর্তমানে দেশের বাজারে প্রসাধন সামগ্রীর গুনগত মানের উপর আস্থা কমে যাওয়ায় অনেকে বিদেশী পণ্য অনলাইনে ক্রয়ের ব্যপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। সেখানেও পুরোপুরি আস্থা খুঁজে পাচ্ছেন না ক্রেতারা!
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুনী সেতু তার বিরুপ অভিজ্ঞতা থেকে প্রতিবেদক কে জানান, তিনি রাজধানীর নিউমার্কেট থেকে ত্বকে ব্যবহৃত ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ ক্রিম ও সিরাম ক্রয় করে ব্যবহারের পর কোনই উপকারিতা পান নি বরং ত্বকের নানা জটিলতার সম্মুখীন হয়েছেন।
এছাড়াও রাজধানীর গভর্নমেন্ট কলেজ অব অ্যাপ্লাইড হিউম্যান সাইন্স কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী স্বীকৃতি প্রসাধনী ক্রয়ের ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করে প্রতিবেদক কে জানান, তিনি ঢাকা শহরের কোন দোকান থেকেই প্রসাধনী ক্রয়ের ব্যাপারে আস্থা পান না। কারন একাধিক বার পণ্য ক্রয় করে প্রতারিত হয়েছেন এবং ত্বকের জটিলতায় ভুগেছেন।
এছাড়াও বিদেশি নামীদামী ব্রান্ডের প্রসাধনী অত্যন্ত সল্প মূল্যে পাওয়া যায় বিভিন্ন বিপনি-বিতানে। ফলে অনেকে সাধ্যের মধ্যে স্বাদ নিতে ক্রয় করে থাকেন এসকল নকল পণ্য।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুরান ঢাকার লালবাগ, চকবাজার, বেগমবাজার, মৌলভীবাজার, মোগলটুলী, ইসলামবাগ, ছোট কাটরা, বড় কাটরা এবং বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারের কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন কারাখানায় তৈরি হচ্ছে এসকল নকল প্রসাধনী সামগ্রী।
তাছাড়া ঢাকার অদূরে সাভার, আশুলিয়া এমনকি উত্তরাঞ্চলসহ নানা জায়গায় তৈরি হচ্ছে নকল প্রসাধনী । তবে চকবাজার, বেগমবাজার ও মৌলভীবাজার এ তিন স্থান থেকেই মূলত রাজধানীসহ সারা দেশে নকল ও ভেজাল প্রসাধনী ছড়িয়ে পড়ছে।
নিয়মিত প্রসাধনী বহারকারীরা নারীরা বলছেন সানস্ক্রিন, লোশন, তেল,পারফিউম,নেইল পলিশ,বডি-স্প্রে,ত্বক ফরসাকারী ক্রিম, টুথপেস্ট, জেল,কন্ডিশনার, ক্রিম, লিপস্টিক, দাগ-মেছতা দূর করার ক্রিম, স্নো, পাউডার এধরনের পণ্য বেশি পরিমানে নকল হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ত্বকে ব্যবহৃত প্রসাধনী যেহেতু মানুষের ত্বক ও স্বাস্থ্যের সঙ্গে সরাসরি জড়িত এবং এর প্রতিক্রিয়া মানুষের দেহে সরাসরি দেখা যায়। এজন্য এসব পণ্য গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া বাজারজাত করা উচিত নয়।
স্কিন কেয়ার বিশেষজ্ঞ ডা. শারমিনা হক বলেন, নকল ও ভেজাল পণ্য ব্যবহার করে মানুষ স্কিন ক্যানসারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় মানসম্পন্ন পণ্য ব্যবহার। প্রসাধন পণ্য ব্যবহারের আগে স্কিন পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত।
ভেজাল প্রসাধনীতে ১৩ ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক পাওয়া গেছে বলে সম্প্রতি জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের বিশেষজ্ঞরা।
এর মধ্যে প্যারাবেন (মিথাইল প্যারাবেন, বিউটেল প্যারাবেন, প্রপেল প্যারাবেন, ইসোবিউটেল প্যারাবেন, ইথাইল প্যারাবেন ইত্যাদি নামে পাওয়া যায় এই রাসায়নিক), ডাই ইথানল এমিন (ডিইএ), বিএইচএ (বিউটিলেটেড হাইড্রক্সি এনিসল) ওবিএইচটি (বিউটিলেটেড হাইড্রক্সি টলুইন), পলি ইথিলিন গ্লাইকল (পিইজি), সোডিয়াম লিউরেল সালফেট এবং সোডিয়াম লিউরেথ সালফেট উল্লেখযোগ্য।
এসব বিষয়ে বিএসটিআইয়ের মান উইংয়ের পরিচালক সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রসাধনীর বাজার দ্রুত বড় হচ্ছে। সেখানে আমাদের অন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মান প্রণয়নের পাশাপাশি প্রসাধনীর মতো পণ্যগুলো নিয়ে যতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত, সেটা হয়তো হচ্ছে না। তবে এটা তদারকির বাইরে নেই।’
তিনি আরো বলেন, ‘এ স্ট্যান্ডার্ড তৈরিও সময়সাপেক্ষ ও কমিটির মাধ্যমে অনুমোদনের বিষয় রয়েছে। যদি কোনো প্রসাধনীর বৈশ্বিক মান নির্ধারিত না থাকে বা কোনো দেশে স্ট্যান্ডার্ড না থাকে তাহলে সেটা আরও দেরি হয়।’
তবে বিএসটিআইয়ের উপপরিচালক মোরশেদা একটি সেমিনারে বেগম বলেন, ‘আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি, বিদেশি পণ্যের চেয়ে আমাদের দেশের পণ্যের মান খারাপ না। শুধু মোড়কের কারণে অনেকে আমাদের দেশের পণ্য পছন্দ করেন না।’
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এসব ভেজাল প্রসাধনী উৎপাদনকারী অসাধু ব্যবসায়ী-চক্রকে চিহ্নিত করে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং নকল পন্যের প্রসার বন্ধ করে ক্রেতাদের মধ্যে পণ্যের গুণগত মান নিয়ে সৃষ্ট সংশয় দূর করা এখন সবথেকে জরুরী। সরকারের নজরদারি বাড়াতে নিয়মিত অধিকতর মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হবে।