গণেযোগ ডেস্ক : বন্দর নগরী চট্টগ্রামে পুরোদমে এবারের মৌসুমের শুঁটকি উৎপাদন শুরু হয়ে গেছে। দেশজুড়ে আলাদা কদর রয়েছে চট্টগ্রামে উৎপাদিত শুঁটকির। স্বাদে-গন্ধে অনন্য এ শুঁটকি মিশে আছে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের সঙ্গে।
উৎপাদিত শুঁটকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে পাঠানো হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশেও। ব্যবসায়ীদের কাছে ক্রমান্বয়ে চট্টগ্রামের শুঁটকি হয়ে উঠছে সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত।
চট্টগ্রামে উৎপাদিত শুঁটকির মুখরোচক স্বাদ যেন প্রকৃতির অকৃপণ ঐশ্বর্য। ভোজনরসিক বাঙালি চট্টগ্রামের শুটকির মুখরোচক স্বাদের সঙ্গে সহজেই তফাৎ খুঁজে নিতে পারেন অন্য শুঁটকির। এ শুঁটকির সুখ্যাতি রয়েছে দেশি-বিদেশি অতিথিদের ভোজনবিলাসেও।
বার্তা সংস্থা বাসস সূত্রে জানা যায়,
দেশে শুঁটকির বৃহত্তর পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের আছাদগঞ্জ শুঁটকি আড়তদার সমিতির কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে দেশে শুঁটকির চাহিদা (প্রতি বছর) রয়েছে প্রায় ৫৪ হাজার ৭৫০ টন। এরমধ্যে দেশে উৎপাদন হয় ২২ হাজার টন। বাকি ৩৩ হাজার টন মিয়ানমার, ভারত ও পাকিস্তান থেকে আমদানি করা হয়। যা মোট চাহিদার ৬০ শতাংশ। আবার দেশে উৎপাদিত শুঁটকি বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে। এরমধ্যে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে চট্টগ্রামে উৎপাদিত শুঁটকির কদরই বেশি।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিকৃত মোট শুঁটকির প্রায় ৭০-৮০ শতাংশই আছাদগঞ্জ ও চাক্তাই পাইকারি বাজার থেকে সরবরাহ করা হয়। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে সমুদ্র এবং দেশীয় উৎস থেকে প্রায় ৪৭ লাখ টন বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধরা হয়েছে, যার মধ্যে ৭ লাখ টন মাছ শুঁটকি উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়েছে।
ইপিবি অনুসারে, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশসহ বিভিন্ন দেশে শুঁটকি রপ্তানি করে বাংলাদেশ ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে ২ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে।
অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, হংকং, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর পরিমাণে শুঁটকি রপ্তানি করা হয়েছে। কারণ প্রাকৃতিক পদ্ধতি প্রয়োগ ও ব্যবহারের কারণে চট্টগ্রাম অঞ্চলে উৎপাদিত শুঁটকির চাহিদা বেশি।
চট্টগ্রাম নগরীর দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরের তীর ছাড়াও কর্ণফুলীসহ বিভিন্ন নদীর তীরে গড়ে উঠেছে দেশের অন্যতম এসব শুঁটকি পল্লী। বিশেষ করে কর্ণফুলী নদীর উত্তর-দক্ষিণ তীরঘেঁষা বাকলিয়া, ইছানগর, ডাঙ্গারচর, কর্ণফুলী ঘাট, ফিসারী ঘাট, চাক্তাই, রাজাখালী, মইজ্যারটেক ও জুলধায় গড়ে উঠেছে বিশাল এ কর্মযজ্ঞ। এ ছাড়া বাঁশখালী উপজেলার সরল ইউনিয়নের কাহারঘোনা, জালীয়াখালী নতুন বাজার সংলগ্ন ও শেখেরখীলের পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা এবং আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের গহিরা বঙ্গোপসাগর তীরের তিন কিলোমিটার জুড়ে রাত দিন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন গ্রামের নারী-পুরুষরা।
এসব এলাকার দুই শতাধিক স্পটে গড়ে তোলা শুঁটকি আড়তে প্রতিদিন সূর্যের তাপে শুকানো হচ্ছে সাগর থেকে সংগ্রহ করা ছোট-বড় ২০ থেকে ২৫ প্রজাতির মাছ।
বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) নগরীর বাকলিয়া ও ডাঙ্গারচর শুঁটকি পল্লীতে সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, বাকলিয়া থানা বাস্তুহারা এলাকার কর্ণফুলীর তীরেই ৯৮একরের বিশাল শুঁটকি পল্লিতে ১২০টি মাচাং এ শুকানো হচ্ছে শুঁটকি।
এ পল্লীতে প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজার শ্রমিক কাজ করেন বলে এখানকার শুঁটকি উৎপাদনকারীরা জানান। এখানে শুঁটকি শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা যার যার মত ব্যস্ত সবাই। যেন দম ফেলার ফুসরত নেই কারো।
পল্লীতে কর্মরত একজন ফ্রমিক জানান, সূর্য ওঠার পর সেই ভোর থেকেই কর্মব্যস্ততা শুরু হয়। আর সূর্য ডোবা পর্যন্ত এভাবে চলে। পাশের আড়তে রাবেয়া খাতুন বলেন, সারাদিন কাজ শেষে মজুরি পাব তিনশ’ টাকা। আর তা দিয়েই চলে সংসার। শুধু ছখিনা-রাবেয়া নয়, তাদের মত দুই হাজারের বেশি নারীসহ প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিকের আয়-রোজগারের উৎস চট্টগ্রামের এই শুঁটকির আড়তগুলো।
শুকাতে দেওয়ার আগে কাঁচা মাছগুলোর মধ্যে যেসব মাছ ছোট সেগুলো ধুয়েই রোদে দেওয়া যায়। তবে যেসব মাছ লম্বা যেমন, ছুরি মাছ আর লইট্যা মাছ, এগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে ছররা বাঁধতে সময় বেশি লাগে। মানুষও লাগে বেশি।
ডাঙ্গারচরে শুঁটকি শুকানো শ্রমিক নুর কাদের জানান, বর্তমানে সূর্যের তাপে ৩-৪ দিনের মধ্যেই কাঁচা মাছ শুকিয়ে গিয়ে শুঁটকিতে পরিণত হচ্ছে। এরপর উৎপাদিত শুঁটকিগুলো বস্তাভর্তি করে ট্রাকে করে পাঠানো হচ্ছে আছাদগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন আড়তে। এমনকি বিদেশেও যাচ্ছে চট্টগ্রামের শুঁটকি।
চট্টগ্রামে শুঁটকির সবচেয়ে বড় বাজার আছাদগঞ্জ। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার শুঁটকির হাট বসে এ বাজারে। হাটের দিন ছাড়াও সাপ্তাহের অন্যান্য দিনও কমবেশি বিক্রি হয় শুঁটকির। যেখান থেকে দেশের মোট শুঁটকি চাহিদার ৩০-৩৫ শতাংশ মেটানো সম্ভব হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি মৌসুমে চট্টগ্রামের এসব আড়তে মাছের গুঁড়াসহ ১৫ থেকে ২০ হাজার মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদন হয়। যার বাজার মূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা। উৎপাদিত এসব শুঁটকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও পাঠানো হয়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ আমেরিকায় বসবাসকারি বাঙালিদের কাছে চট্টগ্রামের শুঁটকির চাহিদা বেশি।
গত বছরের আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে শুঁটকি উৎপাদন মৌসুম শুরু হলেও সাগরে মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় মাছের অভাবে সেপ্টেম্বর মাসে শুঁটকি উৎপাদন হয়নি। তবে শেষ দিকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলেও সাগরে লঘুচাপজনিত কারণে চট্টগ্রামে টানা বৃষ্টি হয়। বর্ষণ থেমে যাওয়ার পর নভেম্বর মাসের শুরু থেকেই ধীরে ধীরে শুঁটকি উৎপাদন শুরু হয়।
উল্লেখ্য,আশির দশক পর্যন্ত শুধুমাত্র বাংলাদেশে শুঁটকি তৈরি হতো। এখন উপকূলবর্তী বিভিন্ন দেশেও শুঁটকি তৈরি হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি শুঁটকি তৈরি হয়। চট্টগ্রামে শুঁটকির ৪০টি আড়ত আছে। আছাদগঞ্জ থেকে সারাদেশের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা শুঁটকি নিয়ে যায়। দেশীয় শুঁটকি দুবাই, সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশে রপ্তানি হয়।
সরকারের সঠিক উদ্যোগ ও সহযোগিতা পেলে বাংলাদেশের শুঁটকি অন্যতম রপ্তানিখাত হতে পারে বলে তিনি জানান।
দেশে শুঁটকির চাহিদা বাড়লেও উৎপাদন বাড়ছে না। ফলে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে শুঁটকি আমদানি হচ্ছে। চিংড়ি, আইড়, পোয়া, গুলশা, বাইন, নলা, পাত্রা, ফাইস্যাসহ প্রায় সব ধরনের শুঁটকি আমদানি হয়। আমদানিকৃত শুঁটকি কোল্ডস্টোরে রাখতে হয়। এতে পোকার আক্রমণ কম হয়।
বঙ্গোপসাগর থেকে আহরণ করা বিশেষ জাতের ছোট আকৃতির মাছগুলো দিয়ে শুটকি উৎপাদন করা হয়। শুধু চট্টগ্রামে নয়, এখানে উৎপাদিত শুঁটকি ঢাকা, রাজশাহী, রংপুর, নাটোরসহ সারাদেশের মানুষের চাহিদা মেঠানো হচ্ছে। এমনকি এখানে উৎপাদিত শুঁটকির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। দেশের মানুষের প্রোটিনের চাহিদার একটি বড় অংশ চট্টগ্রামে উৎপাদিত শুঁটকি থেকে পূরণ হচ্ছে বলে জানান তিনি।
শুঁটকি তৈরিতে মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক কীটনাশক ব্যবহারের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘এ প্রবণতা দিন দিন কমে আসছে। নিরাপদ শুঁটকি উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করতে আমরা নিয়মিত সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি।’
কয়েকটি এনজিও সংস্থার সহযোগিতায় আমরা ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী এবং উৎপাদনকারীদের নিয়ে নিয়মিত উদ্বুদ্ধকরণ সভা করে যাচ্ছি। ফলে কীটনাশকের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে কমে আসছে বলে তিনি দাবী করেন।